চুলের নানাবিধ সমস্যায় আজকাল আমরা সকলেই কমবেশি হতাশাগ্রস্থ! সমাধান খুঁজতে গিয়ে বাজারে পাওয়া সুলভ মুল্যের হেয়ার প্রোডাক্ট বাছাইয়ে মরিয়া হয়ে উঠি। তবে, যত হেয়ার প্রোডাক্ট ব্যবহার করেন না কেন, আপনার চুলের সমস্যা থেকে যেন রেহাই পাচ্ছেন না! আপনি ভাবছেন, মনে হয় এই চুল আর কখনও আগের মত ফিরে পাব নাহ! চুলই পুরোপুরি ড্যামেজ! আসলেই কি চুলে সমস্যা? নাকি আপনার রোজ ব্যবহার করা হেয়ার কেয়ার প্রোডাক্ট দায়ী?
কখনও কি আপনার ব্যবহারকৃত হেয়ার প্রোডাক্টের গায়ে লেবেলে ব্যবহৃত উপাদানগুলো সম্বন্ধে জেনে তারপর কিনেছেন? নাকি শুধুই অফার, ২০% মুল্যছাড় অথবা টেন প্রবলেম ওয়ান সল্যুশন লিখা দেখেই চটজলদি কিনে নিয়েছেন? আপনি জানেন কি, বিভিন্ন হেয়ার প্রোডাক্টে আপনার চুলের জন্য বিষ হিসেবে কাজ করে থাকে!
চুলের সমস্যা সমাধানে হেয়ার কেয়ার প্রোডাক্ট বাছাইয়ে যেসব মারাত্নক ভুল আমরা করে থাকি মুলত তা আজকের আলোচ্য বিষয়। সহজ উপায়ে হেয়ার টাইপস অনুযায়ী বেস্ট প্রোডাক্ট ও বাজারে বিক্রিত ক্ষতিকর উপাদানযুক্ত হেয়ার প্রোডাক্ট কিভাবে চিনবেন তা নিয়ে বিশদ আলোচনা ও থাকছে। চলুন, তবে শুরু করা যাক।
তেল এবং শ্যাম্পু- সচরাচর ব্যবহার করা এই দুইটি মৌলিক হেয়ার কেয়ার প্রোডাক্টে থাকতে পারে ক্ষতিকর কেমিকেল বা হরমোন। নিচে কমন কেমিকেল বা হরমোনগুলোর ক্ষতিকারক দিক ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াসমুহের একটি চটজলদি লিস্ট দেওয়া হল! আপনার বর্তমান অথবা ভবিষ্যত হেয়ার কেয়ার প্রোডাক্টটির উপাদানগুলোর সাথে একঝলকে মিলিয়ে নিন-
ক্ষতিকর কেমিকেল /হরমোন | পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া |
১. প্যারাবেন | অতিরিক্ত চুল ঝরে পড়া,একজিমা,ক্যান্সার। |
২. সোডিয়াম লরাইল সালফেট (SLS) | শুষ্ক-রুক্ষ চুল। ( ড্রাই হেয়ারের জন্য সালফেটযুক্ত শ্যাম্পু ব্যবহার করা অনুচিত) |
৩. ফরমালডিহাইড | অতিরিক্ত চুল ঝরে পড়া, স্কাল্পে ইরিটেশন, ক্যান্সার। |
৪. প্রপিলিন গ্লাইকল | ড্যানড্রাফ, অতিরিক্ত ড্রাইনেস, স্কাল্প ইরিটেশন, চুল অধিক পাতলা হয়ে যাওয়া। |
৫. আইসোপ্রপাইল অ্যালকোহল | হেয়ার ড্যামেজ, চুল ঝড়ে পড়া, অতিরিক্ত ড্রাইনেস। |
৬. কৃত্রিম সুগন্ধিযুক্ত কেমিকেল | অ্যাজমা এটাক, স্কাল্প ইরিটেশন, চুল ঝরে পড়া, ক্যান্সার। |
৭. কুয়াটেরিনিয়াম-১৫ | চোখের জ্বালাপোড়া সৃষ্টি( শ্যাম্পু এবং কন্ডিশনার) |
৮.সেলেনিয়াম সালফাইড | অতিরিক্ত খুশকি |
৯. টলুইন | ইমিউন সিস্টেমে ক্ষতির আশংকা,প্রেগনেন্ট মহিলাদের জন্য বেশ বিপজ্জনক। |
১০. অ্যালকোহল | চুল অত্যাধিক পাতলা হয়ে যাওয়া, চুলে আগা ফাটা বৃদ্ধি। |
আপনার হেয়ার কেয়ার প্রোডাক্ট ক্ষতিকর কিনা ?
ইতোমধ্যেই সংক্ষেপে ১০টি ক্ষতিকর কেমিকেল বা হরমোন সম্পর্কে জেনেছি, যা আমাদের চুলের জন্য খুবই বিপজ্জনক! আপনার ব্যবহৃত হেয়ার কেয়ার প্রোডাক্টে এসকল ক্ষতিকর উপাদান মিশ্রিত থাকলে অবশ্যই আপনি আপনার চুলের অবস্থা ১২টা বানিয়ে ফেলার মহৎ উদ্যেগ নিজের অজান্তে নিয়ে ফেলেছেন।
আবার এ ও হতে পারে, আপনি আপনার হেয়ার কেয়ার প্রোডাক্টটি কিছুদিন ব্যবহারের পর উপকার পেয়েছিলেন৷ কিন্তু ধীরে ধীরে আবার চুলের সমস্যা জটিলতর পর্যায়ে এসে গিয়েছে। তবে বলে রাখা বাহুল্য, বেশিরভাগ ক্ষতিকর উপাদানগুলো ইনস্ট্যান্ট চুলের গ্রোথ, চুলের ড্যানড্রাফ কমানো, চুল সাইনি ও স্ট্রেইট করা, পাকা চুল কালো করাসহ চুলের নানান সমস্যার হালকা প্রতিরোধ করলেও দীর্ঘদিন পর এসব উপাদানগুলোই আপনার চুলের স্বাস্থ্য বিঘ্নিত করার পাশাপাশি ক্যান্সারের মতো দীর্ঘ, জটিলতর রোগের সৃষ্টি করে।
গত ২৭শে অক্টোবর ২০২২ তারিখের এক প্রতিবেদনে জানা যায়,
❝ ব্র্যান্ডেড একটি কোম্পানির শ্যাম্পু বাজার থেকে সরিয়ে ফেলা হচ্ছে কারন তা ব্যবহারে প্রানঘাতি ক্যান্সারে সংক্রমিত হচ্ছে! ❞
সাধারন মানুষ কারনটি জেনেই নিশ্চয়ই আকাশ থেকে পড়বেন। কারন, বাংলাদেশে ইউনিলিভার একটি পরিচিত, বিশ্বস্ত ব্র্যান্ড। এই দেখেই মানুষ পন্য নিশ্চিত কিনে নিচ্ছেন। তবে, এই শ্যাম্পুগুলোতে বেনজিনের মত ক্ষতিকারক রাসায়নিক উপাদান ব্যবহারের জন্য মরনব্যাধি ক্যান্সারে মানুষ সংক্রমিত হচ্ছে।
সুতরাং, অবশ্যই বাজারে বহুল জনপ্রিয় হেয়ার কেয়ার প্রোডাক্টি কেনা আপনার সবথেকে বড় ভুল হতে পারে।
হেয়ার কেয়ার প্রোডাক্টে ব্যবহারকৃত ক্ষতিকর ১০টি কেমিকেল বা হরমোনঃ
জেনে নিন প্রোডাক্টে ব্যবহারের কারন ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
১.প্যারাবেন( Paraben)
বেশিরভাগ হেয়ার কেয়ার প্রোডাক্টেই প্যারাবেন নামক কমন উপাদানটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। মুলত, শ্যাম্পু বা কন্ডিশনারের ভেতর প্যারাবেন প্রেজারভেটিভস হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এতে শ্যাম্পুর ভেতরে ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করেনা। ফলে দীর্ঘদিন আপনার শ্যাম্পুর বোতলটি সুরক্ষিত থাকে।
তবে, এই উপাদানটির ক্ষতিকর দিকটি হল এটি মেয়েদের এস্ট্রজেন হরমোনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এছাড়া, দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে চুল অধিক ঝড়ে পড়া, একজিমা এমনকি ক্যান্সারের মত রোগ ও হতে পারে।
২.সোডিয়াম লরাইল সালফেট ( Sodium Lauryl Sulfate )
সোডিয়াম লরাইল সালফেট অথবা সালফেট বিশেষত সারফেক্টেন্ট হিসেবে কাজ করে। এটি মুলত স্কাল্পে জমে থাকা ধুলাবালি ও ময়লা পরিস্কারক হিসেবে ভুমিকা রাখে। তবে, ড্রাই হেয়ারের জন্য সালফেটযুক্ত শ্যাম্পু ব্যবহার করা সবচেয়ে ক্ষতিকর।
সালফেটযুক্ত শ্যাম্পু ব্যবহারে স্কাল্পে মশ্চরাইজার কমে যেতে পারে। সেইসাথে স্কাল্পে ইরিটেশন, চুলে অতিরিক্ত শুষ্কতা বা ড্রাইনেস দেখা যায়।
৩.ফরমালডিহাইড (Formaldehyde)
ফরমালডিহাইড মুলত “কেরাটিন ট্রিটমেন্ট” নামক বিশেষ হেয়ার ট্রিটমেন্ট এর জন্য ব্যবহৃত হয়। যেসকল শ্যাম্পুতে কেরাটিন ট্রিটমেন্ট উল্লেখ থাকে, মুলত সেসকল প্রোডাক্টে ফরমালডিহাইড এর উপস্থিতি নিশ্চিত হয়।
ফরমালডিহাইডের ব্যবহারের ফলে ইনস্ট্যান্ট সুবিধা পাওয়া গেলেও ধীরে ধীরে চুল পড়া আরও বাড়তে থাকে। সেইসাথে স্কাল্পে ইরিটেশন, ডিএনএ ড্যামেজ এবং ক্যান্সার ও ঘটতে পারে।
৪.প্রপিলিন গ্লাইকল ( Propylene Glycol)
প্রপিলিন গ্লাইকল যেকোন হেয়ার প্রোডাক্টে কমনলি ব্যবহার করা হয়। মুলত, চুলে ইনস্ট্যান্ট কিছু উপকার করলেও এই উপাদানটি দীর্ঘ ও জটিলতর রোগের কারন হয়ে দাঁড়াতে পারে।
প্রপিলিন গ্লাইকলের ব্যবহারে সবচেয়ে বেশি যে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায় তা হলো চুলে অতিরিক্ত ড্যানড্রাফের উপস্থিতি। চুল অত্যাধিক পাতলা হয়ে যাওয়া, চুলে অতিরিক্ত ড্রাইনেস, স্কাল্পে ইরিটেশনের মত সমস্যাও গুলো পরিলক্ষিত হয়।
৫.আইসোপ্রপাইল অ্যালকোহল ( Isopropyl Alcohol)
আপনার হেয়ার প্রোডাক্টে যদি এই উপাদানটি থেকে থাকে অবশ্যই আপনি চুলের কঠিন সমস্যাগুলোয় ভুগবেন। মুলত, আইসো প্রপাইল অ্যালকোহল হপয়ার ড্যামেজের প্রধান কারিগর হিসেবে পরিচিত। এছাড়া, অতিরিক্ত ড্রাইনেস, ড্যানড্রাফের উপস্থিতি, চুল ঝরে পরার মতোও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেকা দিতে পারে।
৬.কৃত্রিম সুগন্ধিযুক্ত কেমিকেল(Fragrance)
আপনার হেয়ার কেয়ার প্রোডাক্টের সুবাসে আপনি পাগলপ্রায়। কিন্তু এই সুবাসের পিছনে যে কৃষতিকর কেমিকেল যুক্ত তা কি জানেন। সাধারনত, হেয়ার প্রোডাকৃটগুলোর লেবেলে লিখা থাকে, প্রাকৃতিক ফুল ও ন্যাচারাল সুগন্ধি ব্যবহৃত হয়েছে। আসলে এখানে কৃত্রিম সুগন্ধিযুক্ত কেমিকেল ব্যবহৃত হয় যা আপনার এজমা এটাকের কারন হতে পারে। এছাড়া, চুল ঝরে পড়া, স্কাল্প ইরিটেশন, ক্যান্সারের মতো রোগ সৃষ্টি ও করতে পারে কৃত্রিম এই কেমিকেলগুলো।
৭.কুয়াটেরিনিয়াম-১৫( Quaternium-15)
বেশকিছু হেয়ার প্রোডাক্টে কুয়াটেরিনিয়াম ব্যবহার করতে দেখা যায়। এটি মুলত সারফেক্টেন্ট ও প্রেজারভেটিবস হিসেবে শ্যাম্পু বা কনৃডিশনারে ব্যবহার করা হয়।
তবে, শ্যাম্পু করার সময় আপনার চোখে লাগলে এই উপাদানটির কারনে চোখে জ্বালাপোড়া বাড়তে পারে।
৮.সেলেনিয়াম সালফাইড ( Selenium Sulfide)
সেলেনিয়াম সালফাইড সবচেয়ে বিপজ্জনক উপাদানের মধ্যে একটি। এটি কার্সিনোজেন বা ক্যান্সার তৈরির কম্পাউন্ড হিসেবে কাজ করে। এছাড়া দীর্ঘদিন এটি ব্যবহারের ফলে অতিরিক্ত ড্যানড্রাফের সমস্যায় ভুগতে পারেন।
৯.টলুইন
টলুইন পেট্রোকেমিক্যাল সলভেন্ট হিসেবে কাজ করে। বিভিন্ন হেয়ার কেয়ার প্রোডাক্টে এর উপস্থিতি বিদ্যমান। টলুইনযুক্ত হেয়ার প্রোডাক্ট আপনার ইমিউন সিস্টেমের ক্সতি করতে পারে। এজন্য, গর্ভাবস্থায় টলুইন যুক্ত হেয়ার কেয়ার প্রোডাক্ট ব্যবহার করা একদমই অনুচিত।
১০.অ্যালকোহল
সর্বাধিক ব্যবহৃত উপাদানগুলোর মধ্যে একটি হল অ্যালকোহল। যেকোন অ্যালকোহল ই চুলের জন্য বেশ ক্ষতিকর। এই উপাদানটি আপনার হেয়ার কেয়ার প্রোডাক্টে উপস্থিত থাকলে আপনি অবশ্যই চুলের নানাবিধ সমস্যায় ভুগবেন।
অত্যাধিক চুল ঝরে পড়া, চুলের আগা ফাটা, চুল পাতলা হওয়া ইত্যাদি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আপনি লক্ষ্য করবেন।
আপনার হেয়ার কেয়ার প্রোডাক্টে কি ধরনের উপাদান থাকা উচিত
হেয়ার কেয়ার প্রোডাক্ট অবশ্যই বাছাইয়ের পূর্বে আপনার পর্যাপ্ত রিসার্চ ও তথ্য সংগ্রহ করা উচিত। মুলত, একটি ভাল হেয়ার কেয়ার প্রোডাক্ট নির্বাচনের ক্ষেত্রে যে ৬টি জিনিস অনেক গুরুত্বপূর্ণ তা হলো-
-
- শ্যাম্পু কেনার পুর্বে অব্যই সালফেট মুক্ত কিনা যাচাই করবেন।
- মাইল্ড শ্যাম্পু সাধারনত উপকারী হয়ে থাকে।
- বিশুদ্ধ নারকেল তেল একমাত্র চুলের জন্য উপকারী। বাড়তি উপাদান হিসেবে প্রাকৃতিক উপাদানগুলোর উপস্থিতি ও এক্ষেত্রে ভাল।
- কন্ডিশনার যাচাইয়ের ক্ষেত্রে তার মধ্যে নারকেল, অলিভ অয়েল, জোজবা, পাম তেল ইত্যাদির উপস্থিতি দেখা আবশ্যক।
- “ হাইড্রোলাইজ কেরাটিন এর উপস্থিতি যা ড্যামেজ হেয়ারকে পুরোরপুরি রিপেয়ার করে।
- ভিটামিন ই, ভিটামিন B5, আর্গান অয়েলের মতো ভিটামনি ও পুষ্টি গুনাগুন হেয়ার প্রোডাক্টে থাকা উচিত। এতে চুল ঝরে পড়া হ্রাস পায়।
এবার আসি বাস্তবতায়, আমি বা আপনি চাইলেও কেমিকেল মুক্ত প্রোডাক্ট ব্যবহার করতে পারব না। আসলে কেমিক্যাল প্রসেসে তৈরি এ সকল প্রোডাক্টে আমরা এমন ভাবে অভ্যস্ত যে, আমাদের এ সকল প্রডাক্ট ব্যবহার করা বন্ধ করাও সম্ভব নয়। তাই ক্যমিক্যাল এর ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য ন্যাচারাল উপাদান এ তৈরী হেয়ার প্যাক বা অয়েল আপনার ড্রেসিং টেবিল এ রাখতেই পারেন। যা আপনার চুলের ড্যামেজ কে অনেক খানি সারিয়ে তুলতে পারে।
বেস্ট ন্যাচারাল হেয়ার অয়েল দেখুন
পরিশেষে
আপনার চুলের যত্নে বিষাক্ত কেমিকেলযুক্ত হেয়ার প্রোডাক্ট ব্যবহার করা থেকে আজই সর্তক হয়ে যান। আপনার হেয়ার কেয়ার প্রোডাক্টের লেবেলে যদি আলোচিত যেকোন কেমিক্যাল থেকে থাকে তবে আজই সেটাকে না- বলুন। এবং পরবর্তীতে অবশ্যই সঠিক উপাদানসমুহ যাচাই করে তবেই নিজের চুলে প্রোডাক্ট ব্যবহার করবেন। আজ এই পর্যন্তই। আশা করি, আজকের এই টিপসগুলো আপনাদের কাজে লাগবে, ইন শা আল্লাহ্!